Call us : 09032-56212
Alternative Text

বেঁচে থাকাই যুদ্ধ এবং শান্তি (উপন্যাস)

ঔপন্যাসিক : মাওলা প্রিন্স। প্রচ্ছদ : রায়হান শশী। প্রকাশনা : নৈঋতা ক্যাফে। প্রকাশকাল : একুশে বইমেলা ফেব্রুয়ারি ২০২২। আইএসবিএন : ৯৭৮-৯৮৪-৮১২৪-৭৩-৪। বহুমাত্রিক, নিরীক্ষাধর্মী ও মহাকাব্যিক উপন্যাস ‘বেঁচে থাকাই যুদ্ধ এবং শান্তি’ থেকে কয়েকটি ‍উদ্ধৃতি : “দিনগুলো বিষাদের, দিনগুলো উত্তেজনার, দিনগুলো হাত-পা গুটিয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করার! দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশে মৃত্যুর হার বেশি, মানুষগুলো কথা শোনে না, নানা অজুহাতে বাহিরে বেড়ায়, মাক্স পড়ে না, বলে ফাঁপর লাগে, ব্যাটা ডোনাল্ড ট্রাম্প হইছে! গার্মেন্টসগুলো কর্মীদের ফোন করে ডাকছে, আবার মিডিয়ার সামনে বলছে, আপনাদের আসতে হবে না, ঘরে বসেই বেতন-বোনাস পাবেন, আবার, আন্তর্জাতিক বাজার হারানোর আশঙ্কায় কিংবা ধরে রাখা পুরনো অর্ডার অনুযায়ী সাপ্লাইয়ের শর্তে বা কারণে কখনো বলছে শিল্প-কারখানার আশেপাশে যেসব শ্রমিক আছেন শুধু তারাই আসবেন, আমাদের বাজার এখন সীমিত, সব শ্রমিকের প্রয়োজন নেই। তবুও দল বেঁধে শ্রমিকেরা পায়ে হেঁটে শত, অর্ধশত কিংবা শত শত কিলোমিটার পাড়ি দিচ্ছে কাজের আশায়, পাওনা বেতনের দাবিতে, বেঁচে থাকার যুদ্ধে, জীবনের সন্ধানে। করোনা হামাক কিছু কইরবে না, করোনা আমগো কিছু কইরব্যার পাইতো না, হামরা কিংবা আমগো না খায়্যায় মরমো, মইরা যাইবো, কাইজ না কইরলে টেহা-টেকা-টাকা দ্যায় নিহি! বাপধন কিংবা বাবাজি, একটা মাস বাড়ির বাইর হই না, বাড়িতে কুনু বা কোনো কিংবা এক ছটাক খাবার নাই, বাধ্য হয়ে বা হইয়্যা আজ বা আইজ বা আইজক্যা বাইর হইছি। হ, হ, পাইছি পাঁচ কেজি চাইল, দুই কেজি আলু, এ্যাক কেজি ডাইল, আধা সের লবণ, দুই লিটার ত্যাল আর হাত বা আত ধোয়ার সাবান বা সাবোন; কিন্তু, তা বা তয় দিয়্যা কয়দিন চলে? মিডিয়া রাজধানী ঢাকা অভিমুখে শ্রমজীবী মানুষের ঢলের করুণ চিত্র দেখালে করুণার চেয়ে কঠোরতা বাড়ে, এমন চললে যে করোনা আরও ছড়িয়ে পড়বে, এমন চলতে দেয়া যায় না! প্রধান প্রধান সড়কে থাকা পুলিশবাহিনী, বিশেষ সময়ে সহায়ক হিসেবে মাঠে নামা সেনাবাহিনী ও রাবের সদস্যরা কঠোর থেকে কঠোরতর হওয়ার কথা শোনায়, কাজও করে, রাস্তায় আর তেমন লোকজন নেই, নাই। এখন সতর্ক শ্রমিকেরা মাছের ড্রামের ভেতর গুটিসুটি হয়ে বসে ট্রাকে উঠে ঢাকা যায়, নারায়ণগঞ্জ যায়, গাজীপুরে যায়! মিডিয়া এই নিদারুণ চিত্রও ফাঁস করে দেয়! গরিবের শান্তি নাই, গরিব মানুষ জীবন বাঁচার জইন্য মাছের ড্রামে করি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর গেইলে করোনা ছড়ায়, আর, বড়লোকেরা প্রাইভেট গাড়িতে চইড়ে ঈদ কইরতে দ্যাশের বাড়ি গেলি করোনা পালায়, উল্টা পথে দৌড়ায়, লৌড়ায়!” [১৬-১৭ : ২৮৮, ২০২২] “তবে কী পৃথিবী ধ্বংস হতে আর বেশি দেরি নেই? স্বর্গ কিংবা নরকের ট্রেন অথবা নৌকা তাহলে কী দাঁড়িয়ে রয়েছে ছেড়ে যাওয়ার অপেক্ষায়? কোনটে বায়, আইসো ক্যা, আইসো সবায়; কিন্তু, আমরা তো যেতে চাই না, আমরা তো এখনো প্রস্তুত নই, প্রস্তুতি নিই নি! জাগো বাহে কোনটে সবায়; কিন্তু, আমরা তো জাগি নি, আমাদের এখনো ঘুম প্রয়োজন, এখনো ঘুম আমাদের গ্রাস করেছে, আচ্ছন্ন করেছে, মোহে আবদ্ধ করে রেখেছে, হামরা যাবার পাবার নই বাহে, হামার ম্যালা কাম বাকি আছে বাপু, হামার ঘুম আছে, হামরা আর এ্যাকনা ঘুমামো, নিন যামো, তারপরোত সুমায় হইলে আসমো, তুমরা যাও, তুমরা যাও, তুমরা চলি যাও বাহে, আর আইসেন না বায়ো, হামার যাবার শখ নাই, ইচ্ছা নাই, আল্লাদ নাই, শক্তিও নাই বাপু…, ফির ডাকেন ক্যা বাহে, অতো জোরে জোরে ডাকেন ক্যা, অতো অতো হাকেন ক্যা, হামার ঘুম নষ্ট করেন ক্যা, আসমান কি কালা কুটকুটা হইছে, ধুমা দিয়্যা ঢাকি গেইছে দেওয়্যা, দজ্জাল কি আইসছে, জানোয়ার দব্বাহ কি ব্যারাইছে, পশ্চিম দিকোত কি সূয্য উইঠছে, ঈসা নবি কি ফির আইসছে, পূব আর পশ্চিম দিকোত কি মাটি ঘটোর-ঘটোর করি কাঁইপপ্যার নাইগছে, ইয়েমেনোত কি আগুন ভলভল করি জ্বইলব্যার নাইগছে; হামাক ক্ষমা করো বাহে, হামরা তুমার সাতে যাবার নই, হামরা তুমার পাছোত তুমার সাতোত যাবার নই…। কান পেতে পুনরায় শুনি, পুনরায়, ফির, আবার, ফের, অতঃপর; হামরা তুমার সাতে যাবার নই, হামরা তুমার পাছোত তুমার সাতোত যাবার নই, তুমার সাতোত-পাছোত হামরা নাই…, মুই যাবার নং…, হামি যামু না রে শালা, হারামির বোঠা…, আমরা যাবো নানে…, আঁই গম ছাড়ি যামু খডে, ফেনি পার ন হই…, যামু ক্যালা, আমরা যামু না…, কিসের লেগে, ক্যানে…, আমরা তোমার লগে যাইবো না…, আমরা যাবো না…, আঁই ন যাই…, হামলোক তেরা সাথমে নাহি যাঙ্গে, তুম যাও…, উই ডন্ট গো উইথ ইউ, উই উইল নট গো উইথ ইউ, ইউ গো অনলি, গো এ্যালোন, ইউ গো প্লিজ…, ডু গিস্ট…, টু ভ্যাস সিল টে প্লেইট…, ইউ নো ভৌ, ভেছে ভাই পুর ফ্যাভোর, ইউ নাও ইরেই…! বস্তুত, কোনো মানুষই পৃথিবী ছেড়ে যেতে চায় না। পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার জন্য কোনো মানুষ কখনো প্রস্তুত থাকেও না। শত কিংবা হাজার অথবা লক্ষ দুঃখ-কষ্ট-হতাশার মধ্যে থেকেও কোনো মানুষ সুস্হ জ্ঞানে অনিশ্চিত স্বর্গ-নরকে যেতে চায় না। এজন্যই তো এতো কান্না, এতো অশ্রুপাত। পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার জন্যই কী মানুষ পৃথিবীতে এসেছে, এসেছিলো!” [৪৯-৫০ : ২৮৮, ২০২২] “শ্রবণেন্দ্রিয়ের চাপে সে বা তিনি চোখ মেলেন, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন, কিন্তু, কোনো উত্তর দেন না, উত্তর দেবার পূর্বে তার চোখ দুটো নিমীলিত হয়ে আসে। তার চৈতন্যে ভেসে উঠে একটি মাঠ। মাঠ নয়, একটি চর। চর নয়, একটি দ্বীপ। দ্বীপের মধ্যে একটি বালুচর। বালুচরের মধ্যে একটি দীঘল মাঠ। মাঠের ভেতর বন। বাবলা বন। জারুল বন। গগনশীরিষ বন। কাঠগোলাপের বন। কাঠবাদামের বন। সে সেখানে একা। তখন সে ভাবে, তখন সে কষ্ট পায়, বাবলা কেনো তমাল নয়? জারুল কেনো পারুল নয়? গগনশীরিষ কেনো আকাশলীনা নয়? কাঠগোলাপ কেনো কাঁঠালপাতা হয় না? কাঠবাদাম কেনো কৃষ্ণচূড়া হতে পারে না? সে ভীষণভাবে একাকীত্ব বোধ করে। তাকে বিচ্ছিন্নতা গ্রাস করে। বাবলা, জারুল, গগনশীরিষ, কাঠগোলাপ কিংবা কাঠবাদামের বন থেকে সে বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অরণ্যের ভেতরে থেকেও সে অরণ্যহীন অরুন্তুদ হয়ে ওঠে। সে শুষ্ক বালুতে পা ঘষে। দু পায়ের পাতা, হাঁটু, কোমর ডুবিয়ে সে নির্জন বালুচরে দাঁড়িয়ে থাকে। তখন তার ক্লান্তি নেই। অবসাদ নেই। ভাবনা-দুর্ভাবনা নেই। বিষাদ নেই। আনন্দ তাকে ছোঁয় না। স্বপ্ন তার কাছে আসতে সাহস করে না। দুঃস্বপ্ন তাকে দেখে উল্টো পথে দৌড় দেয়। তখন সে অরণ্যের কথা ভাবে না। তখন সে আকাশে মুখ তোলে না। তখন সে বালুচরে চোখ রাখে না। তখন সে শুধুই দাঁড়িয়ে থাকে। আর, দাঁড়িয়ে থাকে। হয়তো অচেনা-অজানা-অদেখা কারো জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। হয়তো এমনি এমনিই দাঁড়িয়ে থাকে। হয়তো নিরুপায় হয়েই দাঁড়িয়ে থাকে। নয়তো দাঁড়িয়ে থাকা কোনো রোগে আক্রান্ত হওয়ার জন্যই দাঁড়িয়ে থাকে। স্মৃতিবর্ধক রোগের মতো দাঁড়িয়ে থাকা আর একটি রোগের কারণেই সে দাঁড়িয়ে থাকে। মানুষটা নড়ে না ক্যান, ক্যানে, ক্যালা, অম্বা করি খাড়ায় আছে ক্যাম্বা! খাড়ায় খাড়ায় অঁয় কি কইরস্যে, দাওয়া চায় নিহি! পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছো? পথিক কথা বলে না। পান্থ কথা বলে না। অতঃপর পাখি ডাকলে, কিংবা, সূর্যরশ্মি চোখে পড়লে, কিংবা, বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে লাগলে, কিংবা, বন্য কীট-পতঙ্গ-পশু-প্রাণির দ্বারা আক্রান্ত হলে, অথবা, প্রয়োজনীয় নিদ্রা সম্পন্ন সাপেক্ষে সে জাগরিত হয়। কিন্তু, তখনো সে প্রকৃতিস্থ হয় নি। ভাবাবেগশূন্য ও ভাবলেশহীন সে পূর্বের মতোই দাঁড়িয়ে থাকে। একসময় অনুভূতি ফিরে পেতে শুরু করলে সে প্রথমত মাথা ব্যথা এবং দ্বিতীয়ত কোমর থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত অসারতা অনুভব করে। আস্তে আস্তে তার ভাঙা ভাঙা অনুচিন্তাগুলো ভাষা পেলে সে পুনরায় ভাবতে শুরু করে, সে কেনো অরণ্যমানব, কেনো অরণ্যবৃক্ষ নয়? সে কেনো মানুষ, সে কেনো ঘাসফড়িং নয়? সে কেনো ঘাসফড়িং, কেনো ড্রাগনফ্রাই নয়? সে কেনো ড্রাগনফ্রাই, সে কেনো যন্ত্ররোবট নয়? মাথার মতো তার বুকটাও ভারী হয়ে আসে। টনটন ব্যথা তার নিচে ও উপরে, ভেতরে ও বাহিরে, শরীরে ও আত্মায়। সামূহিক ব্যথার প্রকোপে সে তখন অস্ফুট ও অস্পষ্ট স্বরে উচ্চারণ করে, হয়তো গলা ফাটিয়ে উচ্চারণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে, সে হয়তো ক্রমাগত বলতে থাকে, সে কেনো অরণ্যমানব, সে কেনো অরণ্যবৃক্ষ নয়…, সে কেনো মানুষ, সে কেনো ঘাসফড়িং নয়…, সে কেনো ড্রাগনফ্রাই, সে কেনো যন্ত্ররোবট নয়…, সে কেনো…, কেনো…?” [২২৮-২৩০ : ২৮৮, ২০২২]